বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী পরিকল্পিতভাবে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের প্রকাশিত তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে নির্বিচার হত্যা, গুম, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের ভয়াবহ চিত্র।
গতকাল (বুধবার) সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশন (OHCHR) প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। একই দিনে এক অনলাইন ব্রিফিংয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বলেন, “ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে শেখ হাসিনা সরকার পরিকল্পিতভাবে সহিংস পদ্ধতিতে বিরোধীদের দমন করেছে। এটি একটি সুসমন্বিত কৌশল ছিল, যার মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচার গ্রেপ্তার ও নির্যাতন চালানো হয়েছে।”
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত অন্তত ১,৪০০ জনকে হত্যা করা হয়েছে, যার মধ্যে ১২% শিশু। নিহতদের মধ্যে ৬৬% সামরিক বাহিনীর রাইফেলের গুলিতে, ১২% শটগানের গুলিতে এবং ২% পিস্তলের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে। এছাড়া, ১১,৭০০ জনকে গ্রেপ্তার ও আটক করা হয়।
তদন্তকারী দল ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বগুড়া, সিলেট ও গাজীপুর শহরে অনুসন্ধান চালিয়ে ২৬৬ জনের বেশি প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে।
জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানে উঠে এসেছে, ১৮ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর প্রধানদের দ্রুত প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর ১৯ জুলাই শেখ হাসিনা নিজেই সেনা ও পুলিশ বাহিনীকে “বিক্ষোভকারীদের হত্যা করে লাশ গুম করার” নির্দেশ দেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা সরকার এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এই নিপীড়নের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। দলীয় ক্যাডারদের কাছে অস্ত্র সরবরাহে ১০ জন সংসদ সদস্য, ১৪ জন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, ১৬ জন যুবলীগ নেতা, ১৬ জন ছাত্রলীগ নেতা এবং ৭ জন পুলিশ কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে পালিয়ে রয়েছেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ফলকার টুর্ক বলেন, “যদি কোনো ব্যক্তি গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধে অভিযুক্ত হয় এবং সে বিদেশে অবস্থান করে, তাহলে ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশনের আওতায় তার বিচার সম্ভব।”
এছাড়া, বাংলাদেশ চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC)-এর মাধ্যমে বিচারের উদ্যোগ নিতে পারে। তবে জাতিসংঘ মনে করে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিচারপ্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করা জরুরি।
জাতিসংঘের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রোরি মুনগোভেন বলেন, “যদি বাংলাদেশের বিচারপ্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ না করে, তাহলে আমরা অপরাধীদের বিষয়ে পাওয়া তথ্য হস্তান্তর করব না।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা এমন কোনো বিচারে সহযোগিতা করতে পারি না যেখানে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতে পারে। কারণ, এটি প্রতিশোধের স্থায়ী চক্র তৈরি করে।”
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় বিচার কার্যক্রম শুরু করেছে। জাতিসংঘের সুপারিশ অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক তদন্তের মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা এখন সময়ের দাবি।
এই প্রতিবেদন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক ভয়াবহ অধ্যায়ের চিত্র তুলে ধরেছে। এখন বিশ্ববাসীর নজর বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার দিকে—কীভাবে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়।